মনে থাকবে
গত এক বছরের মধ্যে ঘটা ছোট্ট ছোট্ট কিছু টুকরো স্মৃতি। যেগুলোর আগে-পরের জিনিস সেরম স্পষ্ট মনে নেই আর, কিন্তু এই টুকরোগুলো এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ভবিষ্যতে কি এগুলোও আস্তে আস্তে মুছে যাবে? জানি না। কিন্তু এগুলো লিখে রাখতে ইচ্ছে করছে।
********
স্থান / কাল: কোলকাতায়, এপ্রিল মাসের একটা অতি সাধারণ সকাল।
সকালে অফিস যাওয়ার জন্যে উবেরের বাসে উঠে একটা ফাঁকা সিটে বসেছি। দুচার মিনিট বাস চলার পরে, জানলা দিয়ে রোদ্দুর এসে পড়লো। জানলার ওপর পর্দা ছিল, তবে গিট দিয়ে গোটানো। শীততাপনিয়ন্ত্রিত বাস, রোদ্দুর এসে পড়ায় একটু গরমের ভাব এলো বটে, তবে তেমন কিছু নয়, আমি আলসেমি করে অবজ্ঞাই করলাম।
আমার সামনের সিটে একজন কম বয়েসী (সবে কলেজ পেরিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে হয়তো) মেয়ে বসে। দেখলাম, রোদ্দুর এসে পড়ায়, সে তার জানলার পর্দাটা খুলে ছড়িয়ে দিলো। স্বাভাবিক।
ঘন্টাখানেক পর নামার সময় এলো। আমি নামি একদম শেষের ঠিক আগের স্টপেজে। বাস প্রায় খালি। আমাকে ছাড়া আর দুজন আছে, বাসের আরো সামনের দিকে। আমার সামনের মেয়েটি তখনও বসে। হয়তো শেষ স্টপেজে নামবে। আমি উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি মেয়েটি জানলার পর্দাটা গোটাতে শুরু করেছে। একাগ্রচিত্তে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে,পর্দাটা সুন্দর করে গুটিয়ে, ঠিক আগে যেরকম ছিল, সেরম করে দিলো।
দেখে খুব অবাক হলাম। বাসের চালক এরম কোনও প্রত্যাশা রাখবে না। কাউকে দেখানোর জন্যে তো এটা করা নয়, বাস ফাঁকা, কেউ জানবেও না। আমি নিজেও তো ওরম করতাম না। মেয়েটি সম্পূর্ণ নিজের কোনো মূল্যবোধে, জিনিসটা যেরকম পেয়েছিলো, ঠিক সেরকম করে রেখে গেলো। আমি শুরুতে ওর পর্দা খুলে দেওয়াটা লক্ষ্য করেছিলাম বলে এটার অন্য মানে ধরা পড়লো, নাহলে তো আলাদা কিছু বলে নজরেই আসতো না।
ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে, একটা সুন্দর আবেশের মধ্যে, সেদিন অফিসে ঢুকেছিলাম। ভালো লাগছিলো। অল ইজ ওয়েল।
********
স্থান / কাল: শান্তিনিকেতনের একটা রিসোর্টে, বর্ষাকাল দুপুরবেলা, খুব হালকা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।
পরিপাটি সুন্দর ছাঁটাই করা সবুজ ঘাসের ওপর ফুটবলটা ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে। খুব উপাদেয় একটা শট মারা যায়। মননের মধ্যে রোনালডো, বেকহ্যাম, মেসি, এমনকি ছটোবেলায় শুকতারার পড়া "বিলির বূট" পর্যন্ত সব এসে জুড়ে বসলো। এদের "বডি স্যোয়ার্ভ" করা ফটবলের সাথে পা স্পর্শ করার মুহূর্তের ছবিগুলো। আমার নিজের মাসল মেমারিতেও আছে, ছোটবেলায় রপ্ত করা ছিল, দারুনভাবে শটটা মারতে পারতাম।
আর কে পায়ে। মন, প্রাণ, ধ্যান, সত্তা, সমস্ত এক করে, দৌড়ে গিয়ে, চালিয়ে দিলাম পা।
যা হবার ছিল তাই হলো।
শুধু মাসল মেমারি থাকলেই তো হয়ে না, মাসলটাও লাগে। তার ওপর শরীরের সেন্টার অফ গ্রাভিটিটাও এখন আর ঠিক জায়গায় নেই। একটা সময়ে মাইকেলেঞ্জেলোর 'ভিত্রুভিয়ান ম্যান'-এর সাথে মিলতো চেহারাটা, এখন বুকের ছাতির থেকে পেটের পরিধি একটু বেশি। ফলত, ছবির মতো শটের বদলে হলো ছবির মতো পতন। পরের মুহূর্তে দেখা গেলো, ওই সুন্দর ঘাসের ওপর ষষ্টাঙ্গ অবস্থায় আমি, বলটা যেদিকে যাবার কথা, সেদিকে তাকাচ্ছি। কিন্তু বলের চিহ্নমাত্র নেই। আমার যে অফিস কলিগ মাঠের ওই প্রান্তে ছিল, বলটা সঠিক দিকে গেলে যে রিসিভ করতো, সে চিন্তিত মুখে আমাকে দেখতে দেখতে একপা-দুপা করে আমার দিকে এগোচ্ছে। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, কোনো অদ্ভুত ম্যাজিকে বলটা সম্পূর্ণ অন্য একটা দিকে গড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে কেউ প্ল্যান করে যদি এরকম শট মারতে পারতো, তাহলে কোনো ডিফেন্ডারের বা গোলকিপারের সাধ্য থাকতো না বলটার গতিপথ আগে ঠাহর করা, গোল নিশ্চিত ছিল।
বেরসিক অফিস সহকর্মীরা ভয় পেয়ে খেলাই থামিয়ে দিলো। মুখে বললো "খিদে পেয়ে গেছে , লাঞ্চ করতে হবে এবার", কিন্তু আমি জানি বেটাদের মনের মধ্যে "এই বয়েসে এখানে বেড়াতে এসে হাড়গোড় ভাঙলে মহা বিপদ" চলছে। ভীতুর ডিম সব! এরকম তো শয়ে শয়ে পড়েছি ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে গিয়ে, এসব কোনো ব্যাপারই না!
********
স্থান / কাল: কোলকাতায়, মে মাস, শনিবারের বিকেল।
"স্যার, আপনার সঙ্গে দু মিনিটে কথা বলা যাবে?"
আমি রাস্তায় লোকজনের ভিড় হেকে একটু দূরে এসে, আকাশের দিকে তাকিয়ে, দৈবিক প্রশান্তিতে, সিগাটেররের ধোয়াটা ছাড়ছিলাম। এরকম সময়ে, একটি মেয়ের কণ্ঠে প্রশ্নটি শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখি, কম বয়েসী একটি মেয়ে, গোল গোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সুশ্রী মুখ, সুন্দরও বলা যায়। আমার মেয়েদের বয়েস অনুমান করার ক্ষমতা খুবই গোলমেলে, তাও মনে হলো, হয়তো কলেজে পড়ার বয়েস।
মনের মধ্যে প্রথম যে খেয়াল এলো, সেটা হচ্ছে - হয়তো কোনো সমাজকল্যাণ সংস্থার জন্যে আর্থিক সাহায্য চাইবে। ক্রেডিট কার্ড বিক্রি করার মতো মনে হলো না, হাতে A4 কাগজ রাখার আয়তনের কোনো ফোল্ডার তো নেই। একটা ছোট ব্যাগ আছে।
অবসরপ্রাপ্র মানুষের মতো সময়ের বাহুল্য থাকার ভঙ্গিমায় সিগারেট খাচ্ছিলাম, "সময় নেই" বলার প্রশ্ন ওঠে না। তাছাড়া ওর দিকে তাকিয়ে কথা না বলে বিদায় করে দিতে খারাপ লাগলো।
বললাম, "হ্যা, বলুন।"
"আমি অমুক নাটক সংস্থা থেকে আসছি। আপনি কি নাটক দেখেন?"
"ওই কখনও সখনও একটু দেখি।" (নাটক দেখতেই এসেছিলাম, বুঝলাম টিকেট যে নিয়েছি, সেটা লক্ষ্য করেই মেয়েটি কথা বলতে এসেছে।)
"আগামীকাল সন্ধে সাড়ে ছটায় এখানেই আমাদের সংস্থার একটা নাটক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অমুকের লেখা। ...", বলতে শুরু করে নাটক সম্মন্ধে আরো বেশ কিছু বললো।
আমি মন দিয়ে সব শুনলাম, শুনতে শুনতে মাঝেমধ্যে "ওহ", "আচ্ছা" জাতীয় উত্তর দিছিলাম।
নাটকের বিবরণ দেবার পর, একটু থেমে, একই ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে, মেয়েটি বললো "আপনি কি আসবেন কাল? টিকেট দেব?" চোখেমুখে একটা উৎসাহের ছোঁয়া, একটা আশার আলো। আসা, উৎসাহ, এগুলো মানুষকে কিরকম যেন সুন্দর করে দেয়।
আমি কাল আসবো না আর। আমি জানি। কিন্তু সত্যিটা মুখের ওপর বলতে পারলাম না।
ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, "নানা, যদি আসি, আমি তখনই নিজের টিকিট কেটে নেবো।"
আশায় ভরা চোখমুখের ওপর, স্পষ্ট দেখতে পেলাম, তৎক্ষণাৎ নেমে এলো একটা গভীর হতাশার ভাব। গল্প উপন্যাসের পড়া "মুখের ওপর নেমে এলো ঘন কালো মেঘের ছায়া" আমার চোখের সামনে। ওর ওই চোখমুখের রূপান্তর এখনও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
"আচ্ছা" বলে মেয়েটি চলে গেলো।
নাটকের হলের থেকে আরো দূরে চলে গেলো। ঐদিকে কেন গেলো? নাটক দেখতে আসা লোকজন তো ঐদিকে আর নেই, উল্টো দিকে আছে। ও আরো নাটক দেখতে আসা মানুষজনের সঙ্গে কথা বলবে না? কেউ হয়তো আসতো। কিছু সেকেন্ড পর-পর, ও যেদিকে চলে গেছিলো, সেদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম, ওকে দেখতে পাই কিনা, কোথায় গেলো। নাটকের হলে ঢোকার সময়েও ভালো করে চারদিক দেখলাম। কিন্তু মেয়েটিকে আর দেখতে পেলাম না।
বাহ, কী সুন্দর সব স্মৃতির ছবি। খুব ভালো লাগল, রাজর্ষি। এই সব ছবি দিয়েই তো জীবন, বলুন?
ReplyDeleteএকদম, স্মৃতি তো জীবনের এক মূল্যবান সম্পদ, বিশেষত সুন্দর যদি হয়, বা যদি স্নিগ্ধ করে নেওয়া যায়।
Delete