আরেকটা জন্মের আবেদন

[সূচনা / প্রথম অধ্যায় এখানে]


লাইফে অনেক প্রব্লেম। তনিমা হটাৎ বলে বসলো, এটাই নাকি ওর শেষ জীবন। তাহলে সামনের জন্মের দেখাটা কিকরে হবে! সামনের জন্মে ফুলু কিকরে করবো আমরা? (এখানে বলে রাখি, "ফুলু" শব্দটা ইংরিজি "flirtation/romance" জাতীয় জিনিস এর সাথে "ফুল দেওয়া নেওয়া" ইঙ্গিতজনক একটা ভাবের সমষ্টি।) যাই হোক, প্রব্লেমের বিহিত চাই।

কি আর করব, ঠিক করলাম যে যেতে হবে ব্রহ্মার কাছে, তনিমার জন্যে আরেকটা জীবনের এক্সটেনশনের আবেদন করতে। মহা উৎসাহে গেলাম চলে।  

দরজার ওপর নেমপ্লেটে লেখা "ব্রহ্মা, সিনিয়র গড"। বিশাল দরজা। টোকা মারলাম। শব্দই শোনা গেলো না। যাবে কি করে, আমার মানুষ্য আঙুলের টোকা ওই ১০ ইঞ্চি লোহার দরজা ভেদ করে যাওয়া অসম্ভব।

সাহস করে প্রাণপণে দরজা ঠেলে উঁকি মারলাম ভেতরে। দেখি, এক দাড়িওয়ালা বুড়ো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নানান অঙ্গভঙ্গিতে "ম্যায় সময় হুউউ... !!" বলে চলেছে। তবে কি ভুল জায়গায় এলাম? আবার নেমপ্লেটটা চেক করলাম - না, ঠিকই আছে। বুড়ো বয়েসের ভীমরতি ওটা। মহাভারত সিরিয়ালটা মাথায় চড়ে গেছে!

ভেতরে ঢুকে গলা খাঁকড়ি দিলাম।

বুড়ো হচকিয়ে থেমে গিয়ে স্বর্গ-মর্ত-পাতাল তিন লোকের বিরক্তি মুখে এনে ভুরু কুঁচকে তাকালেন।

"কি চাই?"

"আজ্ঞে, একটা আবেদন নিয়ে এসেছি", বলে তড়িঘড়ি হাতের আবেদন-পত্রটা পতাকার মতো তুলে ধরলাম, বোঝানোর জন্যে যে সব তৈরী হয়েই এসেছি, ডেঁপো ছোকরার মতো হোমওয়ার্ক না করে চলে আসিনি।

বিরক্তি ভরা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে উনি বললেন, "আচ্ছা, দেখা", বলে বিশাল একটা টেবিলের উল্টো দিকে গিয়ে বসলেন।

আমি টেবিলের সামনে গিয়ে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে কাগজটা দিতে গেলাম। ওপার অবধি হাত পৌঁছল না। নিশ্চয় কোনো এক যুগে তিন লোকের বাসিন্দাই টেবিলের ওপার অবধি পৌঁছতে পারতো। মর্ত্যলোকের মানুষের সাইজ নির্ঘাত ছোট হয়ে গেছে।

স্মার্টনেস দেখিয়ে ইমপ্রেস করার এই সুযোগ। "মহা-স্মার্ট" একটা স্টাইলে, সুড়ুৎ করে স্লাইড করে কাগজটা ঠেলে দিলাম ওনার দিকে। সঙ্গে আমার মুখে ফুটে উঠলো তিন লোকের আত্মতৃপ্তি।

আত্মতৃপ্তি টিকলো না। বুড়ো কটমট করে ভস্ম করে দেওয়া চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ফিগারেটিভ নয়, লিটেরালিই উনি ভস্ম করে দিতেন পারেন আমাকে ওই চোখ দিয়ে। কাচুমাচু হয়ে গিয়ে নিজের আঙুলের নখ এমন ভাবে দেখতে লাগলাম যেন এর থেকে বিস্ময়কর জিনিস আর কোথাও নেই।

কয়েকটা সেকেন্ড কাটলো। আচ্ছা, স্বর্গলোকের এক সেকেন্ড আবার মর্ত্যলোকের বিশাল সময় নয় তো? তনিমার বয়েস বেড়ে যাচ্ছে না তো...?

"হুমমম...", টেবিলের উল্টো দিক থেকে আওয়াজ এলো, "এটা তো এক্সট্রা জন্মের আবেদন-পত্র"।
"আজ্ঞে হ্যাঁ", বিগলিত ব্যানার্জী ভাব এনে আমি বললাম।
"কিন্তু নিজের নয় যে, এই তনিমা ছুঁড়ীটি কে?"
"আজ্ঞে, আমার এক বন্ধু।"
"তা, বন্ধুর জন্যে এতো পিরীত কেন, শুনি?"

গলা থেকে কান সব টমেটোর মতো লাল হয়ে গেলো। কৃষ্ণাটা এতগুলো ছুঁড়ীর সাথে ফস্টি-নস্টি করেও কিকরে নীল ছিল জানি না। তবে এই মুহূর্তে, আমার প্রতিচ্ছবি থেকে একটা শুদ্ধ টকটকে লাল রঙের ঠাকুর তৈরী করা যেতে পারতো অনায়াসে।

আমতা আমতা করে "আজ্ঞে,.... ওই,... ও বড়ো ভালো মানুষ..... " জাতীয় হিজিবিজি বলার চেষ্টা করছি, সেই দেখে বুড়ো দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, "ওহ, বুঝেছি, ইন্দ্র-রোগ কেস"।

ইন্দ্র-রোগ...!? ইন্দ্রের অপ্সরাদের প্রতি একটু বেশি মনোযোগ বলে ওর নামে রোগ?

যাই হোক, বুড়ো তারপর ল্যাপটপটা চালিয়ে, ভুরু কুঁচকে, খুটখাট করে কিসব টাইপ করতে থাকলেন।

আমি কাচুমাচু মুখ নিয়ে ততক্ষণে ডান হাতের আঙুলের নখ দেখা শেষ করে বাম হাতে এসে পৌঁছেছি। এমন সময় হটাৎ বিকট বিটকেল ভাবে খ্যাক খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলেন বুড়ো।

আমি হচকিয়ে তাকালাম ওনার দিকে।

"হা হা হা হা..., একটা জীবনের এক্সটেনশন নিয়ে কোনো লাভ নেই", বিতিকিচ্ছিরি ভাবে হেসে বলল  বুড়ো।
"কেন?"
"তোর আগে নিরানব্বই খানা এপ্লিকেশন অলরেডি জমা আছে। একটা জীবন চেয়ে তোর লাভ নেই কোনো।"


বোঝো! তানিমটা করেছেটা কি! আরও একশোটা জন্ম নিতে হবে আমাকে?

ততকাল বা প্রায়োরিটি সার্ভিস বলে কিছু আছে কিনা জিজ্ঞেস করবো কিনা ভাবছি, এমন সময় "হ্যাঁচ্চো, হ্যাঁচ্চো" শব্দ শুনে দেখি তিতিবিরক্ত মুখে কালী ঠাকুর আসছে। কিন্তু একি, একা কেন, শিব কই?

কালী ঠাকুরের আবার চিরকালই বস্ত্রে ভারী অরুচি। ছোটবেলা থেকেই প্যান্ডেলে দেখে এসেছি। এখনো একটিও পড়ে নেই, এমন কি ঠান্ডা লাগা সত্ত্বেও। আমি তড়িঘড়ি চোখ-মুখ নামিয়ে নিলাম। বস্ত্র নেই, কিন্তু হাতে খড়গটা আছে ঠিকই। কান খাড়া করে রইলাম, কি কেস বোঝার জন্যে।

ব্রহ্মা বুড়োও হচকিয়ে ফিরে তাকিয়ে কালী ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলো, "কি রে, তোর আবার কি হলো, ঠান্ডা লাগলো কিকরে?"
"এটা একটা প্রশ্ন হলো!!", কালী ম্যাডাম রেগে আগুন, "আমার কি খালি পায়ে মেঝেতে থাকা অভ্যেস আছে নাকি, ঠান্ডা লাগবে না! শিবের পেটের ওপর থাকাই তো আমার অভ্যেস! ছোটবেলা থেকেই তো ডিপেন্ডেন্সি তৈরী করে রেখেছো!"

"তাই তো! তা, শিবটা  গেলো কই ?", ব্রহ্মা জিজ্ঞেস করলো।
"হতচ্ছাড়াটা হটাৎ ওর পেটের ওপর থেকে আমায় নামিয়ে দিয়ে, জটা দাড়ি ছেঁটে 'ভিরাট কোহলি' ছাট লাগিয়ে, চলে গেলো"
"মানে...? কোথায় গেলো...!?", বুড়ো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
"কি যে বললো, উলু না কুলু কি যেন করতে যাচ্ছে তনিমা নামের এক ছুঁড়ীর সাথে!", কালী ম্যাডাম বললেন।

"ফুলু", আমার মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে পড়লো!

৩+৩=৬ পিস বিস্ফোরিত নয়ন আমার ওপর এসে পড়লো।

আর পারলাম না। মনে মনে তনিমার কাছে ক্ষমা চেয়ে ("তোমার যোগ্য নোই আমি"), চো-চা দৌড়ে ওখান থেকে বেরিয়ে, মর্ত্য-লোকের প্রতি ঝাঁপ মারলাম।

Comments

Popular posts from this blog

ডেটিং অ্যাপ - পরের গল্প

শীতলতার সন্ধানে

ডেটিং অ্যাপ - প্রথম দিন