শীতলতার সন্ধানে

হোয়াটস্অ্যাপে ম লিখলো: "তোমার মধ্যে এতো স্টেবিলিটি আসে কোথা থেকে? এতো কূল, এতো শান্ত ..."।

আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কি! কোথায় শান্তি?

স্কুল কলেজে পড়ার সময়ে, আমার মা প্রায় এক দশক মতো চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলো আমাকে মুক্ত ধারণ করানোর জন্যে, যাতে "মতি স্থির হাওয়া" জাতীয় কিছু একটা হয়। সেই মুক্ত তো ধারণ করিনি। মতিও বোধ হয় স্থির হয়নি, হলে নিশ্চই আকাশ থেকে পড়তাম না ওই কথা শুনে। তবে আমার সম্মন্ধে ভালো কিছু একটা ভাবছে, তাই বুদ্ধিমানের মতো এই বেপারে আর কথা না বাড়িয়ে, বিষয়টা এক্ষুনি পাল্টে ফেলা উচিত।

তৎক্ষণাৎ আমার থেকে যে উত্তরটা বেরোলো সেটা হচ্ছে: "অ্যাঁ ...?"

উচিত কাজ করা, চিরকালই দেখেছি, একদমই সহজ  নয়। ম এক ফোটাও বিষয় থেকে বিচ্যুত না হয়ে আবার জিজ্ঞেস করে বুঝতে চাইলো।

নিজের সম্মন্ধে ভালো ধারণা ভেঙে দিতে একদম মন চায় না। আবার 'কূল'ও বলেছে। ফিল্ম ক্যামেরায় তোলা ছবি সাক্ষী আছে, 'কূল' হবার জন্যে গ্র্যাজুয়েশনের সময়ে হটাৎই একদিন চুল একটু বড় করে, ব্যাকব্রাশ করা শুরু করে, প্রায় এক বছর মতন কাটিয়েছিলাম। এখানে যদিও হুবহু সেই অর্থের 'কূল' নয়, তাও।

কিন্তু আবার বানিয়ে কিছু বলতে গেলেও মনটা খুঁত খুঁত করবে। কি আর করবো, লিখলাম: "ওটা আলসেমি, কাউকে বোলোনা।"

উত্তরটায় সত্যি আছে, কিন্তু উত্তরটা সম্পূর্ণ নয়। লিখে আশা করছিলাম, হয়তো পাত্তা দেবে না, বা হয়তো ভাববে ইয়ার্কি। কিন্তু মুশকিল হলো, ম একটু বিরল প্রজাতির মানুষ, এখনও সরলভাবে মানুষকে বিশ্বাস করার ক্ষমতা রাখে। আর ওকে বহু বছর ধরে চিনি, সেই সুবাদে দেখেছি, অন্য মানুষের সম্মন্ধে এমন এমন সত্যি ও হটাৎ দেখতে পায়, যেটা অতিশয় বিবেচক মানুষরাও অনেক তথ্যর পরও বুঝতে পারেনি। আমার কথায়, কে জানে, কতটা কি বুঝেছিলো সেদিন।


যাই হোক, এই উক্তি আমার পুরানো একটা স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো। সেই স্মৃতিটা লিখবো বলেই এই লেখার সূত্রপাত।

বহু বছর আগের কথা। তখন কলেজ থেকে ক্যাম্পাসিংএ চাকরি পেয়ে 'উইপ্রো'তে কাজে যোগ দিয়েছি। প্রথম তিন মাস বাঙ্গালোরে ট্রেনিং দেওয়া হবে। এই তিন মাসের মধ্যে, প্রথম এক মাস প্রশিক্ষণ কোনো নির্দিষ্ট প্রযুক্তির ওপর নয়, এই সময়টা লজিকাল রিসনিং, এলগোরিদম, কমিউনিকেশন, টীম বিল্ডিং, ইত্যাদি নিয়ে আমাদের পাকাপোক্ত করা হবে।

ওই এক মাস আমরা যারা একসাথে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিলাম, সেই সকলের মধ্যে, একটি মেয়েকে আমার অন্যদের থেকে বেশি আকর্ষণীয় লাগতে শুরু করেছিল। সে দেখতেও খুবই সুন্দর ছিল, আর বুদ্ধিমতীও ছিল। সাধারণত, প্রশ্ন বা অনুশীলনের উত্তরগুলো ও সবার আগে দিতো (আর, ইয়ে, কখনো কখনো আমিও দিতাম, সত্যি!!)। ওর সাথে বেশ ভালো আলাপ হয়ে গিয়েছিলো। কদিনের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম, কোন যেন ম্যাজিকে, আমার বসার জায়গাটা আস্তে আস্তে পাল্টে গিয়ে ওর সিটের কাছাকাছি হয়ে যাচ্ছে, এবং অবশেষে একদম ওর পাশেই হয়ে গিয়েছিলো। ততদিনে আমাদের মধ্যে কথাবার্তা, হাসি-ঠাট্টা হতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে, অন্যরা সুযোগ পেলে আমাকে হালকা লেগ-পুলও করতে শুরু করেছিল, ওর প্রতি দুর্বলতার ইঙ্গিত দিয়ে। বলাই বাহুল্য, আমার মধ্যে তো দুর্বলতা, সেটা যেরকমই হোক না কেন, থাকতেই পারে না, তাই পুরো বেপারটা তাদের কাছে তীব্রভাবে অস্বীকার করতাম।

এই এক মাসের একদম শেষ দিনে, আমাদের প্রশিক্ষক একটা সুন্দর অনুশীলন দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যে আমাদের সবারই তো অনেক নতুন মানুষের সাথে আলাপ হয়েছে এই এক মাসে, তা এর ম্যধ্যে যাদের সঙ্গে ভালো আলাপ হয়েছে, তাদের সম্মন্ধে প্রশংসামূলক, বা তাদের নিয়ে ভালো একটা কিছু, একটা কাগজে লিখে, তাদের দিতে।

আমি নিজে কাকে কি লিখে দিয়েছিলাম সেগুলো এখন আর মনে নেই। কিন্তু যে কাগজগুলো আমি পেয়েছিলাম, তিন চার বছর পরেও সেগুলো ফেলতে পারিনি দেখে, অবশেষে একদিন সেগুলোকে নিজের ডায়েরির পাতায় সাঁটিয়ে দিয়েছিলাম। সেই ডায়েরি এখনও আছে, কিন্তু খুলে দেখলাম, লেখাগুলো অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সেই মেয়েটি ছাড়া, অন্যরা যা দিয়েছিলো, সেগুলোকেও এই সুযোগে এখানে ধরে রাখি, পরে কখনো মনে পড়লে সহজে পাওয়া যাবে। অন্যদের দেওয়াগুলোই আগে তুলে ধরি। এখন আঠেরো বছর পর নামগুলো বাদ দেবার আর প্রয়োজন মনে করছি না।



ওপরের দুটো দেখে তখন খুব অবাক হয়ে ভেবেছিলাম "আমার কথা বলছে?", এখনও একই রকম অবাক হই, এবং এখন যারা আমায় দেখে, তারাও অবাক হবে।


ওপরের লেখাটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। যেটা ছিল সেটা বোধ হয় এইরকম: "u have a nice name. Hope we become good friends. U have a good attitude. U will rise in life."

আর সেই মেয়েটি যে লেখাটা দিয়েছিলো, ম-এর উক্তি শুনে সেদিন আমার যেটার কথা মনে পরে গিয়েছিলো, যেটার কথা ভেবে এই লেখাটা লিখতে ইচ্ছে হলো, যেটা দেখে আঠেরো বছর আগের সেদিনে আমি বেশ মর্মাহত হয়ে ভেবেছিলাম "যাহ বাবা, এটা আবার কি, সবাই কত ভালো ভালো লিখলো, আর ওই কিনা...", সেটা নিচে দেওয়া রইলো। 

তখন বুঝিনি এটা কত সুন্দর উপহার।

Comments

  1. বাবাগো আপনার সম্পর্কে সবাই কত প্রশংসা করেছে, রাজর্ষি! আমার তো এ ধরণের খেলায় নামারই সাহস হবে না।

    পোস্টটার মধ্যে একটা হুহু করা ভালোলাগা আছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হেহে, শুধু প্রশংসা করেছে নয়, একদম "রিটেন" দিয়ে দিয়েছে, তাও আবার সই করা! ভবিষ্যতে কেউ এই সব বিষয়ে উল্টো কিছু বলতে গেলেই, সোজা এগুলো নাকের সামনে তুলে দেখিয়ে দিয়ে "হেন্স প্রুভড" বলে দেওয়া যাবে, একদম রিটেন প্রুফ আছে আমার কাছে।

      সাধারণত এই রকম জিনিসে যোগ দিতে গেলে আমারও অস্বস্তি হবে, তবে সেইদিন এই অনুশীলনে আমরা সবাই ছিলাম, যতদূর মনে পড়ছে, পুরো ক্লাস মিলে। আর সবাই যে বেশ খোলা মনেই এতে যোগদান করতে পেরেছিলো তার পুরো ক্রেডিট যিনি প্রশিক্ষক ছিলেন ওনার। দারুন একটা সহজ পসিটিভ আবহাওয়া তৈরী করে দিয়েছিলাম।

      Delete
    2. না না, আমি বুঝেছি এটা আপনি যেচে যোগ দেননি। এটা গ্রুপ অ্যাকটিভিটি। আমারও অভিজ্ঞতা আছে। আর হয়তো এ সব এক্সারসাইজের পর একটা সার্বিক পজিটিভিটির পারিপার্শ্বিক তৈরি হয়। এত দুঃখকষ্ট হেরে যাওয়ার মধ্যে যা অত্যন্ত প্রেশাস। আমি ওটা রসিকতা করেই লিখেছিলাম। ভালো থাকবেন। আপনার গলা ভালো জানতে পারলাম। গান করেন? কখনও সুযোগ হলে শুনব।

      Delete
    3. না না না, গান একেবারেই পারি না। ওটা গানের ভয়েস বলেনি।

      তাহলে একটা ঘটনা বলি।

      জীবনে কখনো গান শিখিনি, অন্তাক্ষরীতেও কেউ কখনো 'ভালো গাই' বলেনি, তাও কলেজের শুরুতে, বন্ধুরা একটু বলাবলি করাতেই, ফার্স্ট ইয়ারের অ্যানুয়াল ফাংশনের নাচ, গান, সবেতে নাম লিখিয়ে ফেললাম, "কুছ পরোয়া নেহি, দেখাই যাক না" মনোভাব নিয়ে। 'গান জানি না' বলে আমার স্থান হলো কোরাসে। এরপর, কোরাসে প্র্যাক্টিস করতে গিয়ে, অদ্ভুত একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম - আমি যখন মনেপ্রাণে গলা ছাড়ছি, কোরাসের বাকি সদস্যরা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চুপ হয়ে যাচ্ছে। দুতিনবার হবার পর, যে গান লিড করেছিল তাকে ধরে বুঝলাম, যে আমি এতোই বেসুরো গাইছি, বাকিরা না পেরে উঠে থেমে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এটার পর আমাকে গান শেখানোর প্রয়াসও করা হয়েছিল কিছুদিন। কলেজের মধ্যেই, আলাদা ঘরে, হারমোনিয়াম নিয়ে একদম প্রাইভেট সেশন। আমাদের সেই গানের দলের যে লিড, সে হারমোনিয়ামটা বাজাতো, আর আমি গলা দিয়ে নানারকম শব্দ করতাম। শেষমেশ অবশ্য আমিই আত্মত্যাগ করলাম, কারণ দেখলাম যে আমাকে এতো সময় দিয়ে একমাত্র যে পরিবর্তনটা ঘটছে, সেটা হচ্ছে অন্যদের অনুশীলন করার সময়টা কমে যাওয়া।

      Delete
    4. আর আমার আগের কমেন্টে, শেষ "দিয়েছিলাম"টা "দিয়েছিলেন" হবে।

      Delete
  2. আমার ভূবনে স্বাগতম

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকেও স্বাগত জানাই।

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ডেটিং অ্যাপ - পরের গল্প

ডেটিং অ্যাপ - প্রথম দিন